‘হ্যাঁ, অবশ্য দেখা যায়। সাকার রূপ দেখা যায়, আবার অরূপও দেখা যায়। তা তোমায় বুঝাব কেমন করে? ব্যাকুল হয়ে তাঁর জন্য কাঁদতে পার? লোকে ছেলের জন্য, স্ত্রীর জন্য, টাকার জন্য একঘটি কাঁদে। কিন্তু ঈশ্বরের জন্য কে কাঁদছে? যতক্ষণ ছেলে চুষি নিয়ে ভুলে থাকে, মা রান্নাবান্না, বাড়ির কাজ সব করে। ছেলের যখন চুষি আর ভাল লাগে না— চুষি ফেলে চিৎকার করে কাঁদে। তখন মা ভাতের হাঁড়ি নামিয়ে দুড়দুড় করে এসে ছেলেকে কোলে লয়।... যে ব্যক্তি সদা-সর্বদা ঈশ্বর চিন্তা করে, সেই জানতে পারে তাঁর স্বরূপ কী। সে ব্যক্তিই জানে যে তিনি নানা রূপে দেখা দেন, নানা ভাবে দেখা দেন— তিনি সগুণ, আবার তিনি নির্গুণ। যে গাছতলায় থাকে, সেই জানে যে বহুরূপীর নানা রঙ— আবার কখন কখন কোনও রঙই থাকে না। অন্য লোক কেবল তর্ক ঝগড়া করে কষ্ট পায়। কবীর বলত, ‘নিরাকার আমার বাপ, সাকার আমার মা’। ভক্ত যে রূপটি ভালবাসে, সেই রূপেই তিনি দেখা দেন— তিনি যে ভক্তবৎসল। পুরাণে আছে, বীরভক্ত হনুমানের জন্য তিনি রামরূপ ধরেছিলেন।’
আর এর পরই অজ্ঞাত, অপরিমেয় অনন্তকে বোঝাতে গিয়ে শ্যামারূপ ও শ্যামরূপের যে-ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন ঠাকুর, তা শুনলে অতি বড় ভক্তেরও বুক কেঁপে যাবে এটুকু ভেবেই যে, ঠাকুরকে পুরোপুরি বোঝা কি অত চাট্টিখানি ব্যাপার! ওঁর মুখেই শোনা যাক, সে দিন ঠিক কী বলেছিলেন তিনি?
‘বেদান্ত-বিচারের কাছে রূপ টুপ উড়ে যায়।... যতক্ষণ ‘আমি ভক্ত’ এই অভিমান থাকে, ততক্ষণই ঈশ্বরের রূপদর্শন আর ঈশ্বরকে ব্যক্তি বলে বোধ সম্ভব হয়। বিচারের চক্ষে দেখলে ভক্তের ‘আমি’ অভিমান ভক্তকে একটু দূরে রেখেছে। কালীরূপ কি শ্যামরূপ চৌদ্দ পোয়া কেন? দূরে বলে। দূরে বলেই সূর্য ছোট দেখায়।... আবার কালীরূপ কি শ্যামরূপ শ্যামবর্ণ কেন? সেও দূর বলে... আকাশ দূরে দেখলে নীলবর্ণ, কাছে দেখ কোন রঙ নাই।... অনন্ত ঈশ্বরকে কি জানা যায়? তাঁকে জানবারই বা কি দরকার? এই দুর্লভ মানুষ জনম পেয়ে আমার দরকার তাঁর পাদপদ্মে যেন ভক্তি হয়।’ অর্থাৎ ভাবসাগরে ডুবে থাকা মা ভবতারিণীর যে-ছেলের সবচেয়ে বড় পরিচয় কি না মাতৃসাধক, তিনিই আবার স্পষ্ট বলছেন, যতক্ষণ নিজের ভক্তরূপের অভিমানটি থাকে, ততক্ষণই ঈশ্বরের রূপদর্শন হয় আর তাঁকে ব্যক্তি বোধ হয়। তার পর তাঁর আর আলাদা রূপ নেই। এও কি সম্ভব?
হ্যাঁ, সম্ভব। ওই যে ঠাকুর একবার বলেছিলেন, ‘আমায় সব ধর্ম একবার করে নিতে হয়েছিল—হিন্দু, মুসলমান, খ্রীষ্টান, শাক্ত, বৈষ্ণব, বেদান্ত।’ এই হল সেই উত্তর। পূর্ণব্রহ্মের কাছে চিরদিনই সব রহস্যের পাতা খোলা ছিল স্বচ্ছ শিশিরের মতন। নইলে ঠাকুর সেই ব্রাহ্ম ভক্তকে সে দিন শেষ কথাটি শোনাবেন কেন— ‘যদি আমার একঘটি জলে তৃষ্ণা যায়, পুকুরে কত জল আছে এ মাপবার কি দরকার?’ প্রণাম তোমায় ঘনশ্যাম!
Eisamay Gold/spirituality/kalpataru sri ramakrishna