প্যাংগং লেক বা আট আঙুলের লড়াই

fontIcon
China@War room
07 Feb 2021, 07:00:00 PM IST

‘থ্রি ইডিয়টস’-খ্যাত প্যাংগং লেক। এবং সেখানকার ফিঙ্গার ১ থেকে ফিঙ্গার ৮। চিন-ভারত সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দু। এখন তো বটেই, অনেক দিন ধরেই। কেন এত গুরুত্বপূর্ণ এই এলাকা?

ইনিও সোনম ওয়াংচুক, থাকেন লাদাখেই, তবে সেই ‘থ্রি ইডিয়টস’-খ্যাত ইঞ্জিনিয়র নন। তা বলে কম বিখ্যাতও নন, কারণ এই ভদ্রলোক রিটায়ার্ড কর্নেল এবং বীরত্বের জন্য দেশ তাঁকে মহাবীরচক্র দিয়ে সম্মানিত করেছে।

এই সোনম ওয়াংচুক সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, লাদাখ স্কাউটস থেকে আরও বেশি ট্রুপকে এলএসি-তে নিয়ে যাওয়া উচিত। কারণ, এই ট্রুপ এলাকার ভূগোলের সঙ্গে, আবহাওয়ার সঙ্গে অনেকটাই বেশি পরিচিত, ফলে তাদের পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে সুবিধা হবে।

আশার খবর, ভারত এবং চিনের মধ্যে বর্তমান সংঘাত নিয়ে আলোচনা থেমে যায়নি। ২২ জুন সোমবার, এলএসি-র চিনা অধিকৃত অংশে মোলদো নামে একটি জায়গায় দু’দেশের কর্পস কম্যান্ডারদের বৈঠক। ৬ জুনের পরে আবার। দু’দেশই এলএসি বরাবর সামরিক শক্তির বহর বাড়িয়ে চলেছে বটে, তবে দু’তরফই যে আলোচনার টেবিলে বসতে তৈরি, আশার খবর সেটাই।

এই ফাঁকে জানিয়ে রাখা যাক, এলএসি-র যে এলাকাটি এখন বিতর্কের কেন্দ্রে, সেই প্যাংগং লেক সম্পর্কে কিছু জরুরি তথ্য।

সাম্প্রতিক চিন-ভারত সংঘাতে যদিও বারবার উঠে আসছে গলওয়ান উপত্যকার কথা, আসল ফোকাস হল এই ১৩৫ কিলোমিটার লম্বা লেকটি।

আমরা যখন করোনা নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত, সেই মে মাসের শুরুতেই কিন্তু ঝামেলাটির সূত্রপাত। তবে সেই প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে এখানকার ভৌগোলিক চেহারা নিয়ে কিছু কথা বলা দরকার।

এখানে পাহাড়ের ঢাল সরাসরি নেমে এসেছে জলের মধ্যে। যেখানে তারা ঢুকে এসেছে লেকে, সেই পয়েন্টগুলির নাম দেওয়া হয়েছে ‘ফিঙ্গার’, অর্থাৎ আঙুল। যেন তারা আঁকড়ে ধরেছে এই দিগন্তবিস্তৃত জলরাশিকে। এই রকম আটটি ‘ফিঙ্গার’ রয়েছে এইখানে। এবং এখান দিয়েই গেছে চিন ও ভারতের মধ্যবর্তী এলএসি, অর্থাৎ লাইন অফ অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল।

কিন্তু সেই লাইনটা ঠিক কোথায়? এই নিয়েই যত গণ্ডগোল। ভারতের দাবি ফিঙ্গার এইট দিয়ে গেছে এই এলএসি, যার পরেই চিনের শেষ মিলিটারি পোস্ট। অর্থাৎ, ফিঙ্গার এইট পর্যন্ত ভারতীয় এলাকা। অন্য দিকে চিনের দাবি, মোটেই তা নয়, আসলে এলএসি গেছে ফিঙ্গার টু দিয়ে।

তা হলে এখন ফিঙ্গার টু এবং ফিঙ্গার এইট-এর মধ্যের এলাকাটির কী অবস্থা? ভারতের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আছে ফিঙ্গার ফোর পর্যন্ত এলাকা। তবে সেখানে সেনাবাহিনী প্যাট্রোল করতে পারে ফিঙ্গার এইট পর্যন্ত। অন্য দিকে চিন প্যাট্রোল করে ফিঙ্গার ফোর পর্যন্ত, যদিও মাঝেমধ্যে ফিঙ্গার টু পর্যন্তও তারা চলে আসে।

অর্থাৎ, হিসেব করে দেখলে প্রায় ১৪ হাজার ফুট উঁচুতে অবস্থিত এই লেকটির তিন ভাগের দুই ভাগ চিনের নিয়ন্ত্রণে, বাকিটুকু ভারতের।

আজ থেকে প্রায় দু’দশক আগে কারগিল যুদ্ধের সময়, যখন ভারতীয় সেনাবাহিনী পাক সেনার মোকাবিলায় ব্যস্ত, সেই ফাঁকে ভারতের নজর এড়িয়ে ফিঙ্গার ৪ পর্যন্ত একটা কাঁচা রাস্তা বানিয়ে ফেলে চিন। পরে সেটিকে পিচ দিয়ে ঢেকেও দেওয়া হয়। ২০১৪-১৫ সালে চিন এই ফিঙ্গার ফোর-এই একটি স্থায়ী কাঠামো তৈরি করে, যা ভেঙে দেওয়া হয় ভারতের তরফে জোরালো প্রতিবাদের পর। এগিয়ে আসুন আরও দু’বছর। ২০১৭। ডোকলামে শুরু হয়েছিল চিন-ভারত সংঘাত। সে বারও চিনা সেনাবাহিনী ঢুকে এসেছিল ফিঙ্গার ফোর পর্যন্ত। এ বছরের মে মাসে ঝামেলা শুরু হয় ফিঙ্গার ফাইভে। চলতি মাসে ভারতীয় সেনাবাহিনী যখন গলওয়ান উপত্যকায় ব্যস্ত, তখনই চিন ফিঙ্গার ফোর থেকে ফিঙ্গার এইট পর্যন্ত বিস্তৃত পাহাড়চূড়াগুলি দখল করে নেয়, ফলে এলাকাটির নিয়ন্ত্রণও চলে যায় তাদের হাতে।

প্রশ্ন হল, এই আট আঙুলের জায়গা নিয়ে চিন এত উৎসাহী কেন? নিশ্চয়ই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য নয়। দু’টি সম্ভাব্য ব্যাখ্যা আছে তার।

প্যাংগং লেক স্ট্র্যাটেজিকালি গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি চুসুল উপত্যকার কাছে। ১৯৬২ সালে এই চুসুল উপত্যকাই ছিল অন্যতম ব্যাটলফ্রন্ট। যদি প্যাংগং লেক বরাবর চিন কিছুটা এগিয়ে আসতে পারে, ভারতকে বেঁধে রাখতে পারে একটা নির্দিষ্ট গণ্ডিতে, চুসুল উপত্যকায় নজরদারিও তাদের জন্য অনেক সহজ হয়ে যাবে।

দ্বিতীয় ব্যাখ্যাটি হল, চিন চায় না এলএসি-র কাছের এলাকাগুলোতে ভারত নতুন পরিকাঠামো তৈরি করে। কারণ সেটি হলে আকসাই চিন এবং লাসা-কাশগর হাইওয়ের উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আশঙ্কা দেখা দিতে পারে। লাসা-কাশগর হাইওয়ে তাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ পিওকে এবং পাকিস্তানের উপর তাদের যে আধিপত্য, সেটা বজায় রাখার অন্যতম উপায় এই হাইওয়ে।

শেষে একটি অ্যানেকডোট। ঝকঝকে নীল জলের যে লেকটির ধারে চুমু খেয়েছিলেন আমির খান এবং করিনা কাপুর, ‘থ্রি ইডিয়টস’ ছবিতে, সেটিই প্যাংগং লেক। দেখতে স্বপ্নের মতো যদিও, হালফিল সেখানে দুঃস্বপ্নের দশা।

গল্প রেট করুন