আরও শুনুন বা পড়ুন:
Trade Slaves : দাসব্যবসার জন্য বাঙালির কাছেও ক্ষমা চাইলেন ডাচ রাজা
১৬২২ থেকে ১৬২৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে করমণ্ডল উপকূল থেকে প্রায় ১৯০০ মানুষ জাহাজে চাপে। ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্তারা তখনও হতাশায় মুহ্যমান। এক ঘোষণায় ভীষণ খেদের সঙ্গে তাঁরা জানাচ্ছেন, শুধুমাত্র অর্থের অভাবে আরও দু’হাজার মানুষকে কেনা যায়নি। ১৬১৮-২০-র দুর্ভিক্ষের ফলশ্রুতিতে সেই প্রথম এত বেশি সংখ্যায় দাস রপ্তানি সম্ভব হয়েছিল। এর পর ক্রমান্বয়ে যুদ্ধ বিগ্রহ, খরা, মহামারী কোম্পানির জাহাজের পালে আরও হাওয়া দিয়েছিল। সঙ্গে ছিল তাঞ্জাভুর দখলের উদ্দেশ্যে বিজাপুর রাজ প্রেরিত একের পর এক অভিযান শেষে আটক হওয়া নির্দোষ মানুষেরা। এদের মধ্যে থেকে চলত দাস-বাছাই। শারীরিক ভাবে অক্ষম হলে জাহাজে ঠাঁই মিলত না। কারণ ক্রীতদাসেদের মূলত কৃষিকাজ অথবা অন্যান্য কায়িক শ্রমের কাজে লাগানো হত। ষোলো শতকের চল্লিশের দশক থেকে আশির দশকের মধ্যে প্রায় ১৫ হাজার মানুষ ডাচ উপনিবেশের উদ্দেশে পাড়ি দিয়েছিল। ততদিনে কেনাবেচার ক্ষেত্রে মোটামুটি একটা ফিক্সড রেট তৈরি হয়ে গেছে। ২০ থেকে ৩৬ বছর বয়স্ক পুরুষের দাম সাড়ে বারো রিয়াল, বারো থেকে পঁচিশ বছরের মেয়ের দাম আট রিয়াল, আট থেকে উনিশ বছরের ছেলে বিকোবে সাড়ে সাত রিয়ালে, সাত থেকে বারো বছর বয়সী মেয়ের দাম ছয় রিয়াল, ছোট বাচ্চাদের দাম আর একটু কম সাড়ে তিন রিয়াল। এর চেয়েও ছোট বাচ্চা নিতে চাইলে বিনামূল্যেই পাওয়া যেত। সস্তা কি না বলুন! তবে সবচেয়ে সস্তায় ভারতীয় দাস বিক্রি করার কৃতিত্ব সম্ভবত আর একজনের। তিনি গজনীর সুলতান মামুদ। ১০১৮-১৯-এ ভারতবর্ষে অভিযান শেষে ফেরার পথে এত ভারতীয় দাস সঙ্গে করে নিয়ে যান, যে তাদের দাম কমে দাঁড়ায় মাত্র দুই থেকে দশ দিরহাম।
তা হলে ভারতীয় দাস রপ্তানির জন্যে শুধু গোরাদের গাল পাড়লে হবে না? এর আগেও দাস বিক্রির প্রথা বজায় ছিল? ঠিক। শুধু বিক্রি নয়, অনেক সময় দৌত্যকার্যে বিভিন্ন উপঢৌকনের সঙ্গে কিছু ভারতীয় দাসও পাঠানো হত।
কেন?
এর পিছনে ছিল স্থাপত্য-ভাস্কর্যে ভারতীয়দের অসাধারণ দখল। Skilled Labour হিসেবে মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন সাম্রাজ্যে ভারতীয় দাসের কদর ছিল সর্বাধিক। এখনও পরিস্থিতি খুব একটা বদলেছে কী? দাস প্রথা নেই বটে কিন্তু উপযুক্ত পারিশ্রমিকের বিনিময়ে ভারতীয়দের স্কিলের ব্যবহার করতে সব দেশই সমান ভাবে আগ্রহী। মোগল সাম্রাজ্যে দক্ষ শ্রমিকের ঘাটতির আশঙ্কায় ভারতীয়দের আকছার বিদেশে পাঠানোয় রাশ টানা হয়। আঠারো শতক থেকে মধ্য এশিয়ার বাজারে ভারতীয় শ্রমিকের হার কমতে থাকে। তার আগে গৃহস্থালির কাজ থেকে শুরু করে বাগানের দেখভাল ইত্যাদি অনেক কাজে ভারতীয় দাস নিয়োগ করা হত। সম্রাট বাবরের স্মৃতিকথাতে হিন্দুস্থান থেকে বাণিজ্যে যাওয়া বণিকদের সঙ্গে অন্যান্য উপকরণের সাথে ক্রীতদাসের উল্লেখও পাওয়া যায়। তবে সব জায়গায় ভারতীয়দের কদর যে সমানভাবে বজায় ছিল তা বলা যায় না। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইন্টেলিজেন্স অফিসার মোহনলাল কাশ্মীরি এক গোপন অভিযানে বুখারায় গিয়ে দেখেছিলেন, সেখানে ভারতীয় ক্রীতদাসের বাজারে চরম মন্দা। কেউই তাদের কিনতে চায় না। কারণ? তারা নিকৃষ্ট এবং অপবিত্র। অবশ্য ইতিহাসের নিরিখে একে ব্যতিক্রম বলেই ধরা যায়। অন্তত দেশে বিদেশে যেভাবে ক্রীতদাস হিসেবে ভারতীয়দের রমরমা? হ্যাঁ। দেশেও। সে যুগে অধীনস্ত দাসের সংখ্যার উপর ভিত্তি করেই সামাজিক মর্যাদার গ্রাফ চড়াই উতরাই পেরত। উনিশ শতকে কলকাতায় কোম্পানির কোর্ট হাউস থেকে দাস মালিকদের জন্যে রীতিমত পারমিট ইস্যু করা হত। মূল্য? চার টাকা চার আনা।
প্রাচীন ভারতে বৈদিক যুগে দাসপ্রথার প্রচলন নিয়ে বিতর্ক আছে। তবে অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন সেসময় যুদ্ধাপরাধীদের দাস হিসাবে গণ্য করা হত। পরবর্তীতে মেগাস্থিনিস তাঁর ভ্রমণকথায় তৎকালীন ভারতবর্ষে দাসপ্রথা নিষিদ্ধ ছিল বলে জানান। এদিকে পরবর্তীতে সম্রাট অশোকের শিলালেখে দাসেদের প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। ফলে এ বিষয়ে বিতর্কের অবকাশ রয়ে গেছে। কিন্তু যে বিষয়ে ঐতিহাসিকেরা সবাই একমত তা হল সুলতানি শাসনে দাসব্যবস্থা বহাল তবিয়তে বর্তমান ছিল। ভারতের বুকে মামলুক বংশের প্রতিষ্ঠাতা কুতুবুদ্দিন আইবক অথবা তাঁর জামাতা ইলতুৎমিস দুজনেই সামান্য দাস থেকে রাজসিংহাসনের মালিক হয়েছিলেন। ক্রমে ব্যক্তিগত দাস রাখা সুলতানদের অভ্যাসে পরিণত হয়। সম্রাট আলাউদ্দিন খিলজির অধীনস্ত দাসের সংখ্যা ছিল পঞ্চাশ হাজার। এছাড়া নির্মাণকার্যের শ্রমিক হিসেবে আরও সত্তর হাজার দাস বরাদ্দ ছিল। তাঁর সাম্রাজ্যে এমন কোনও দিন যায়নি যেদিন দাস কেনাবেচা হতনা। সম্রাট ফিরোজ শাহ তুঘলক দেড় লক্ষের উপর দাস রেখেছিলেন, যাদের মধ্যে বারো হাজার দক্ষ শ্রমিক হিসেবে নিযুক্ত ছিল। কত ছিল তাদের দর? ক্রীতদাসীদের দর আট টাকা, তবে সে যদি রক্ষিতা হওয়ার যোগ্য হয় তার দাম বেড়ে দাঁড়াবে পনেরো টাকায়। ক্রীতদাস বালকেরা বিক্রি হত চার দিরহামে। যুদ্ধাপরাধী ছাড়াও অনাদায়ী কর উসুল করতে করদাতাকে দাস বানিয়ে নেওয়ার রীতি ছিল। মোগল আমলে আঞ্চলিক বিদ্রোহ দমন শেষে পুরুষদের শিরচ্ছেদ করে মহিলা ও ছোট ছেলেমেয়েদের দাসে পরিণত করা হত। পরগণার দায়িত্বে থাকা শিকদাররা রাজস্ব আদায় না হলে কৃষকদের দাস বানিয়ে রাখতেন। পরবর্তীতে সম্রাট ঔরংজেব ফতোয়া-ই-আলমগীরিতে দাস মালিকদের অবশ্য পালনীয় কিছু রীতিরও উল্লেখ করেছিলেনl
কন্ঠ: শৌণক সান্যাল
Eisamay Gold/history/dutch east india company trade slaves from india part 2