জাস্ট এক পাত্তর মহুয়া, হবে নাকি?

fontIcon
Mahua
31 Dec 2023, 10:02:01 AM IST
Image Source: iStock

ছোটনাগপুরের অরণ্যভূমিতে ছিল গোন্ড উপজাতির বাস, যাঁদের জীবন থেকে মৃত্যুর প্রতিটি স্তরে জড়িয়ে আছে মহুয়া! শুধু সুরা হিসেবে নয়, মহুয়া গাছই তাঁদের জীবনের অঙ্গ। আপন বিশেষত্বেই হুইস্কি, ওয়াইনের কৌলীন্যের মাঝে আজও সসম্মানে টিকে রয়েছে ঝিম ধরানো মহুয়া নেশা।

আজ থেকে অনেক অনেক বছর আগে মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, ওডিশা, ছত্তিসগড় এবং পশ্চিমবঙ্গের রাঢ় অঞ্চলের এক বিস্তীর্ণ এলাকা গভীর জঙ্গলে ঢাকা ছিল। ছোটনাগপুরের মালভূমি নামে চিহ্নিত এই পাহাড়ি অরণ্যভূমিতে গোন্ড উপজাতিরা বসবাস করত, যাদের নাম থেকেই গন্ডোয়ানাল্যান্ড কথাটি এসেছে। মুখ্য জীবিকা শিকার এবং চাষবাস ছাড়া তাদের ছিল মহুয়া, যাকে বাদ দিয়ে বাঁচার কথা তারা কল্পনাও করতে পারত না।

আজ মহুয়া বলতেই আমরা বুঝি, একটা ঝিম ধরানো আদিম নেশা, একটা তীব্র আকর্ষণ, যা এড়িয়ে যাওয়া শক্ত কিন্তু গোন্ডদের কাছে মহুয়া মানে জীবন... মহুয়া মানে শাশ্বত চিরন্তন এক দেবতা যে তাদের বাঁচিয়ে রাখে। গোন্ড উপজাতিদের পুরাণ-গ্রন্থেও মহুয়া গাছের উল্লেখ পাওয়া যায়, সেখানে এই গাছকে ভীষণ পবিত্র বলে মনে করা হয়, তাই তারা মহুয়াকে ‘জীবন বৃক্ষ’ বলে ডাকে।

গোন্ড উপজাতি সমাজের প্রতিটি স্তরেই জড়িয়ে আছে মহুয়া। এদের ক্যালেন্ডারে নতুন বছর শুরু হয় চৈত্র মাস থেকে। এই চৈত্র মাসে মহাপরব পালন করা হয়, যেখানে মহুয়া ফুল ভীষণভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল— এই তিনমাস মহুয়া গাছ ফুলে ভরে থাকে। এর পর আবার বর্ষাকালে সেই মহুয়া ফুল থেকে সুরা তৈরির আগে মহুয়া উৎসব পালিত হয়। অর্থাৎ একটা গাছে ফুল আসা এবং ফুল ফোটা ধরে তৈরি হয় একটি উপজাতির উৎসব। তা ছাড়া এই উপজাতির কাছে মহুয়ার কান্ড, ডাল, ফুল, ফল— সবই খুব পবিত্র। ঐতিহ্য, সংস্কৃতি বা জীবন সংগ্রামে একটি গাছের এমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা বিশ্বে বিরল।

শুধুমাত্র গোন্ড উপজাতিরা নয়, এই অঞ্চলের বেশিরভাগ আদিবাসীদের কাছে মহুয়া ভগবানের আশীর্বাদ। শুধুমাত্র সুরা নয়, তারা এই গাছের ফল এবং বিভিন্ন অংশ সিদ্ধ করে, গুঁড়িয়ে বা রস করে সুস্বাদু খাবার তৈরি করে। শুকিয়ে যাওয়া কাঠ জ্বালানির কাজে লাগে। কোয়া উপজাতিরা তো এই গাছের কাঠ দিয়েই তাদের অন্তিম যাত্রার চিতা সাজায়, তারা বিশ্বাস করে মহুয়া কাঠের আগুন ছাড়া মানুষের দেহের প্রকৃত পঞ্চত্ব প্রাপ্তি হয় না।

Mahua collection

চিনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ এ দেশের পানীয়ের মধ্যেও শ্রেণিবৈষম্য লক্ষ করেছিলেন। সামাজিক প্রতিষ্ঠা অনুযায়ী সেই সময়ের মানুষ তাঁর উপযুক্ত সুরাটিকে বেছে নিতেন। তাই ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং তথাকথিত নিম্নবর্গের লোকজনের পছন্দের পানীয় একই রকম ছিল না। সমাজের অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে সুরাও সে সময় সামাজিক শ্রেণির একক ছিল অর্থাৎ সুরা দেখে মানুষের শ্রেণি চেনা যেত। কিন্তু সেই সুরা যদি মানুষের জীবনযাত্রার প্রতিটি স্তরে অপরিহার্য হয়ে ওঠে, তা হলে বেশ অবাকই হতে হয়। ঠিক এমনটাই দেখা গিয়েছিল গোন্ড উপজাতিদের মধ্যে। এই আদিবাসীদের জীবন-জীবিকা, সমাজ-সংস্কৃতি ইত্যাদি সব কিছুই একটি গাছের ওপর নির্ভরশীল ছিল, যাকে আমরা চিনি মহুয়া নামে, যে মহুয়া গাছের ফুল থেকেই তৈরি হয় পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন সুরা।

এ তো গেল আদিবাসীদের কাছে মহুয়ার গুরুত্বের কথা। এ যুগেও মহুয়ার গুরুত্ব অপরিসীম। মহুয়ার ফুল ও ফল থেকে তেল, সাবান, মাখন ইত্যাদি ছাড়াও ওষুধ তৈরি হয়। শুনলে অবাক হবেন, খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে রচিত আয়ুর্বেদ গ্রন্থ চরক-সংহিতাতেও মহুয়া গাছের উল্লেখ আছে। সেখানে মহুয়ার রসকে মহৌষধ বলা হয়েছে। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক সি পি খাঁড়েও তাঁর লেখা বইয়ে মহুয়াকে ব্রঙ্কাইটিস এবং সর্দিকাশির অতি কার্যকরী ঔষধ বলে বর্ণনা করেছেন।

এত সমৃদ্ধ ঐতিহাসিক ঐতিহ্য থাকা সত্ত্বেও মহুয়ার গায়ে কেমন যেন গ্রাম্য, জংলি গন্ধ। জঙ্গলের পথ পেরিয়ে আজও হয়তো সে এলিটদের রাজপথে উঠতে পারেনি। উজ্জ্বল, ঝাঁ চকচকে হুইস্কি বা ওয়াইনদের মতো সম্মান পায়নি, কিন্তু প্রকৃত সুরাপ্রেমীদের কাছে মহুয়া ভীষণভাবে সমাদৃত। কারণ তাঁরা জানেন, বর্ণহীন, পরিস্রুত মহুয়া জাপানের জনপ্রিয় সাকে ড্রিঙ্কস বা মেক্সিকোর জগদ্বিখ্যাত টাকিলার থেকেও সুস্বাদু এবং পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ। তাই সরকারি উদ্যোগে সম্পূর্ণ বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতিতে মহুয়া ফুল থেকে সুগন্ধি ও সুস্বাদু মহুয়া তৈরি করে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিলে তা জনপ্রিয় হবেই। তাই জংলি মহুয়া ওয়াইন, হুইস্কি, শ্যাম্পেনদের সরিয়ে উজ্জ্বল আলোর নীচে চকমক করে উঠবেই, যে তার সাবলীল ছন্দে, নিজস্ব মদিরতায় আজও বেঁচে আছে এক জীবন-বৃক্ষ হয়ে।


Web Title:

Mahua Intoxication,Mahua alcohol percentage,Mahua uses,Mahua alcohol benefits,Mahua flower uses, tropical mahua tree, drunk on mahua.

(Bengali podcast on Eisamay Gold)

গল্প রেট করুন