আত্মনির্ভর ট্রাম, বিজলি পথের গল্প

fontIcon
Trams in Kolkata
12 Dec 2021, 07:00:00 PM IST
Image Source: BCCL

নোনাপুকুর ট্রাম ডিপো। কলকাতার তো বটেই, গোটা দেশের পাবলিক ট্রান্সপোর্টের ইতিহাসেই সেই জায়গাটির কথা চিরকাল অমর হয়ে থাকবে। কিন্তু কেন?

আরও শুনুন বা পড়ুন:
লেবেদেফ: এক ফলকের একটু দেখা
আতর যেত ঠাকুরবাড়ি, নবাবি মহলেও
ফোর্ট উইলিয়ামের খাঁচায় আওয়ধের নবাব
রবি ঠাকুরের চিঠি, বার্থ কন্ট্রোল জরুরি
জেনানা মহলে রাজপুত্র, কলকাতা তোলপাড়


মল্লিকবাজার থেকে ট্রাম-লাইন যেখানে এলিয়ট রোডের দিকে বাঁক নিয়েছে, ঠিক তার উল্টো দিকেই নোনাপুকুর ট্রাম ডিপো। তখনকার দিনের লোয়ার সার্কুলার রোড, হালফিল আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু রোড, সংক্ষেপে এ জে সি বোস রোডের ঠিক ওপরেই। এখন দেখতে ধূসর, সে ভাবে কোথাও ফলক-টলকে উল্লেখও করা নেই, কিন্তু এইটুকু জেনে রাখুন যে, জায়গাটি হিস্টরিক।

কেন হিস্টরিক, সে কথাই এ বার বলব। তার আগে একটু অন্য কথা। বিশেষ এই ট্রাম ডিপোটি ট্রাম ছাড়াও আরও নানা কারণে বেশ বিখ্যাত। ‘কাহানি’, ‘পিকু’ এমন আরও নানা ছবির শুটিংও হয়েছে এই ডিপোতে। বড় মাপের শুটিং চললে যা হয়, প্রচুর লোকজন এসেছে, একঝাঁক ‘স্টার’ এসেছেন, এসেছে ভ্যানিটি ভ্যান, হাজির হয়েছে একটার পর একটা জেনারেটর ভ্যান, যাতে লাইট-টাইট ঠিকমতো জ্বালানো যায়।

আসুন, আজকের এই গল্পটা জেনারেটর নিয়েই হোক। ভাবতেই পারেন, জেনারেটরের সঙ্গে কলকাতার, আরও ভেঙে বললে নোনাপুকুরের কী সম্পর্ক?

সম্পর্কটা এই যে, আপনি যখন ওই এলাকায় যাবেন, ঘোরাঘুরি করবেন, একটু খেয়াল করবেন তো, ট্রামডিপোর ঠিক লাগোয়া রাস্তায় আবছা হয়ে যাওয়া একটা বোর্ড দেখা যাচ্ছে কি না! সেখানে লেখা আছে ‘বিজলি রোড’।

খুঁজে পেলে ভালো, না পেলেও জেনে রাখুন, আপনি যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন, কলকাতার তো বটেই, গোটা দেশের পাবলিক ট্রান্সপোর্টের ইতিহাসেই সেই জায়গাটির কথা চিরকাল অমর হয়ে থাকবে।

কারণ, নোনাপুকুর ট্রামডিপোতে তখনকার দিনের ক্যালকাটা ট্রামওয়েজ কোম্পানি বিদ্যুৎ তৈরির জন্য প্রথম একটি নিজস্ব জেনারেটর বসিয়েছিল।

ভাবতেই পারেন, এ আর এমন কী? উঁহু, ঠিক তা নয়।

কেন এই জেনারেটর বদলে দিয়েছিল তৎকালীন ভারতীয় রাজধানী শহরের ছবি, সেটা বুঝতে গেলে ইতিহাসে আরও একটু ডুব দিতে হবে।

আমরা সকলেই জানি, এক সময় কলকাতায় ট্রাম টানত ঘোড়া। ১৮৭৩-এর ২৪ ফ্রেব্রুয়ারি শিয়ালদহ রেল স্টেশন থেকে আর্মেনিয়ান ঘাট পর্যন্ত ঘোড়ায়-টানা ট্রাম চালু হল। গোড়ায় কোম্পানি চেয়েছিল, এই ট্রাম মালপত্রই বইবে, মানুষ নয়। বাস্তবে দেখা গেল, প্রথম দিন থেকে সেখানে মানুষই চড়েছে এবং প্রায় বিনা পয়সায়। ফলে মাত্র সাতটি মাস চালানোর পর লোকসান এতটাই যে, বন্ধ করে দিতে হল সেই ট্রাম সার্ভিস।

এগিয়ে আসুন আরও সাত বছর। ১৮৮০-র ১ নভেম্বর থেকে ফের নতুন করে ট্রামযাত্রা শুরু হল কলকাতায়। এ বারের বাহনও সেই ঘোড়া। প্রথমে চালানো হল সেই পুরনো পথেই, অর্থাৎ, শিয়ালদহ থেকে আর্মেনিয়ান ঘাট পর্যন্ত। তার পর একে একে চৌরঙ্গি রোড, চিৎপুর রোড, ধর্মতলা স্ট্রিট, স্ট্র্যান্ড রোড, শ্যামবাজার, খিদিরপুর, ওয়েলেসলি স্ট্রিট। তখন ব্রিটিশ রাজত্বের সাধের শহর কলকাতা। দেশ-বিদেশ থেকে মানুষ বাসা করছে এই শহরে। পাল্লা দিয়ে ট্রামের জনপ্রিয়তাও বাড়তে লাগল। আরও নতুন নতুন রাস্তায় পৌঁছে গেল ট্রাম।

tram old

এতে যাতায়াতের গতি বাড়ল বটে কিন্তু পাশাপাশি দেখা দিল অন্য কিছু অসুবিধা। ভিড়ের রাস্তায় ট্রামের ঘোড়া মাঝে মাঝেই ভয় পেয়ে যেত, তখন তাদের উলটোপালটা দৌড়াদৌড়িতে গাড়ি ছিটকে যেত লাইন থেকে। এতে বেশ কিছু পথচারী মানুষের আহত হওয়ার খবরও পাওয়া গেছে। ট্রাম কোম্পানি ভাবল, কিছু রাস্তায় ঘোড়ার বদলে স্টিম ইঞ্জিন দিয়ে ট্রাম চালালে কেমন হয়? চেষ্টা হল, কিন্তু খুব একটা সুবিধে হল না।

তা হলে উপায়? তত দিনে কলকাতায় ইলেক্ট্রিসিটি এসে গেছে। ইংল্যান্ডের ‘দি ইন্ডিয়ান ইলেক্ট্রিক কোম্পানি লিমিটেড’-এর পক্ষে ‘কিলবার্ন অ্যান্ড কোম্পানি’ কলকাতা শহরে ইলেক্ট্রিক সাপ্লাইয়ের লাইসেন্স পেয়েছে। মাসখানেকের মধ্যেই সেই কোম্পানির নাম পাল্টে হল ‘দি ক্যালকাটা ইলেক্ট্রিক সাপ্লাই কর্পোরেশন লিমিটেড’। সেই কোম্পানি প্রিন্সেপ স্ট্রিটের কাছে ইমামবাগ লেনে ‘ক্রম্পটন’ ডায়নামো, ‘উইলান্স’ ইঞ্জিন এবং ‘বেকক অ্যান্ড উইলকক্স’ বয়লারের সাহায্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র তৈরি করল। ফলে, ১৮৯৯-এর ১৭ এপ্রিল থেকে শহর কলকাতায় সরকারি ভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরুও হয়ে গেল।

ট্রাম কোম্পানি দেখল এটাই সুযোগ। ইলেক্ট্রিসিটি থাকতে ঘোড়া দিয়ে ট্রাম চালাব কেন? তারা সরকারের কাছে এই বিষয়ে অনুমতি চাইল। অনুমতি পেতে দেরি হয়নি। ১৯০২-এর ১৪ জুন খিদিরপুরে চালু হল প্রথম ইলেক্ট্রিক ট্রাম। তার পর ধাপে ধাপে কলকাতার সমস্ত রাস্তায়।

সমস্যা হল একটাই। এত বিদ্যুৎ মিলবে কী করে? একে তো শহরে তখন সবেমাত্র বিদ্যুৎ এসেছে, তাই পথঘাটে আলো জ্বালানোর জন্য একা কর্পোরেশনই অনেকটা বিদ্যুৎ কিনে নেয়, তার উপর রাজভবন-সহ শহরের বিভিন্ন সরকারি বাড়িতে ইলেক্ট্রিক লাইন বসেছে। শহরের ধনী লোকেরাও বাড়িতে বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে আরম্ভ করেছেন। ফলে এত বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ সরবরাহ ক্যালকাটা ইলেক্ট্রিক সাপ্লাই কর্পোরেশনের পক্ষে আর সম্ভব হল না।

তখন উপায়? ট্রাম কোম্পানি সিদ্ধান্ত নিল, ট্রাম চালাবার জন্য প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ নিজেরাই তৈরি করে নেব। ফলে, নোনাপুকুর ট্রামডিপোয় বসানো হল একটি জেনারেটর। গোটা দেশের মধ্যে সেই প্রথম। এখন ভাবলেও অবাক লাগে, ট্রাম কোম্পানি তখন বিদ্যুতে আত্মনির্ভর। কলকাতা শহরের বুকে তাদের নিজস্ব ইলেক্ট্রিসিটি দিয়েই তারা গোটা পরিষেবাটা চালাচ্ছে। গোটা দেশের মধ্যে প্রথম তো বটেই, বেনজিরও।

ফলক থাক আর না-ই থাক, সম্পূর্ণ এই ইতিহাসটা থেকে গেল ছোট্ট একটি রাস্তার নামে।

বিজলি রোড।

এখনও যখন শুটিং হয়, সেখানেই সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকে জেনারেটর ভ্যান। চুপ করে সে দিকে তাকিয়ে থাকে নোনাপুকুর ট্রাম ডিপোর প্রাচীন, বোবা ইমারত।

Web Title:

Story of Nonapukur Tram Depot -Bengali podcast

(Bengali podcast on Eisamay Gold)

গল্প রেট করুন