সূর্যোদয়ে তুমি, সূর্যাস্তেও তুমি

fontIcon
alauddin
15 Aug 2020, 07:00:00 PM IST

‘ইস্টিশানের রেলগাড়িটা’ বা ‘বন্ধু তিন দিন তোর বাড়িতে গেলাম’—শুনেছেন নিশ্চয়ই? সুরসৃষ্টি যাঁর, সেই আলাউদ্দিন, বাংলাদেশের সফলতম, সুরকার প্রয়াত। তাঁর প্রয়াণের পর এ বাংলা এবং ও বাংলার প্রচারমাধ্যমে তাঁকে নিয়ে লেখালেখিতে আরও একবার স্পষ্ট ঢাকা-কলকাতা এখনও সুরের টানে কাছের হল না।

ভূপিন্দর সিং তাঁর বাংলাদেশি গায়িকা স্ত্রী মিতালি মুখোপাধ্যায়কে ওই ভদ্রলোক সম্পর্কে বলতেন, ‘বাংলাদেশের আরডি বর্মণ’।

‘বাংলাদেশের আরডি’ আলাউদ্দিন আলির সব হারানোর দেশে যাওয়ার খবর শুনে চোখের সামনে ভেসে এল এক লং প্লে রেকর্ডের ছবি। সত্তর দশকের শেষ দিকে রুনা লায়লার রেকর্ড। মোহময়ী ছবি। এখনকার দিন হলে লেখা হত, সেক্সি ছবি। তত দিনে আমরা শুনে ফেলেছি, ‘সাধের লাউ’য়ের সঙ্গে ‘বৈরাগী’র কী অন্তহীন সম্পর্ক! হেমন্ত কিছুটা শীতের দিকে ঢলে গেলেও শারদঅর্ঘ্যের বসন্তবাহারে ঝলমলে মান্না-কিশোর-আশা-আরতি-ভূপেন। রুনা ওই সোনার সময়ে, ১৯৭৭ সালেই গঙ্গাপারের হৃদয় মুঠোয় নিয়েছেন ‘সাধের লাউ’য়ের সঙ্গে তিনটি অতি প্রচলিত ভাওয়াইয়া গেয়ে।

দু’বছর বাদে, একচল্লিশ বছর আগের পুজোয় রুনা লায়লা এলেন আলাউদ্দিন আলির হাত ধরে। বাকিদের মতো তারা হয়ে জ্বলতে থাকলেন পুজোর গানের আকাশে। আলাউদ্দিনের তৈরি সেই আটটি সুরেলা গান আজও বাঙালির বুকের গহীনে। একই সঙ্গে কত আধুনিক, কত গ্রামীণ সে সুর। ‘বাড়ির মানুষ কয়’, ‘সুখ রে তুই আর কত কাল’, ‘মাঝি তুমি মাঝগাঙে’, ‘কলের গাড়ি তাড়াতাড়ি’, ‘বুকে আমার আগুন জ্বলে’, ‘জানি গো ফুরাবে রাত’। এক একটা গান, এক একটা স্মৃতির মালা। ওই সময়ই বাঙালির গানের প্রেমে জায়গা করে নিয়েছিল রুনা-আলাউদ্দিনের আরও কিছু মোহময় গান, ‘ইস্টিশানের রেলগাড়িটা’, ‘হায় রে স্মৃতি বড় জ্বালাময়’।

আলাউদ্দিন— বাংলাদেশের সফলতম সুরকারের প্রয়াণের পর এ বাংলা এবং ও বাংলার প্রচারমাধ্যমে তাঁকে নিয়ে লেখালেখিতে আরও একবার স্পষ্ট একটা মনখারাপ করা সত্য। ঢাকা-কলকাতা এখনও সুরের টানে কাছের হল না। কলকাতার অধিকাংশ প্রচারমাধ্যমে চূড়ান্ত উপেক্ষিতই থেকে গেলেন আলাউদ্দিন। রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমিনরা যাঁকে উপমহাদেশের অন্যতম সেরা সুরকার বলেন। ও দিকে ঢাকায় বিভিন্ন কাগজে আলাউদ্দিনের সেরা সৃষ্টি বলে গোটা কুড়ি গানের তালিকা দেখা গেল, তাতে ‘বন্ধু তিন দিন তোর বাড়িতে গেলাম’ ছাড়া কলকাতায় বিখ্যাত এই গানগুলোর একটাও নেই। যে গানগুলো ও পার বাংলার সংবাদমাধ্যমে গুরুত্ব পেয়েছে, সে সব আবার এ পার বাংলার আমরা শুনিইনি সে ভাবে। চলচ্চিত্র ও বেসিক রেকর্ডের সব গান।

তালিকা অন্তহীন। ‘একবার যদি কেউ ভালোবাসত’, ‘যে ছিল দৃষ্টির সীমানায়’, ‘ভালোবাসা যত বড় জীবন তত বড় নয়’, ‘দুঃখ ভালোবেসে প্রেমের খেলা খেলতে হয়’, ‘আছেন আমার মোক্তার আছেন আমার ব্যারিস্টার’, ‘সুখে থাকো ও আমার নন্দিনী’, ‘যেটুকু সময় তুমি থাকো’, ‘শত জনমের স্বপ্ন তুমি আমার জীবনে এলে’, ‘যেভাবে বাঁচি বেঁচে তো আছি’, ‘চক্ষের নজর এমনি কইরা’— এমন অসংখ্য গানের তালিকা সেখানে।

আলাউদ্দিনের অন্যতম সেরা সৃষ্টি ‘বন্ধু তিন দিন তোর বাড়িতে গেলাম’-এর ইতিহাস কী? রুনা সে গান ১৯৮০ সালে ঢাকায় ‘কসাই’ নামে বিখ্যাত সিনেমায় গেয়েছিলেন। বাংলাদেশের অনেক কাগজে লেখা হয়েছে, আলাউদ্দিন প্রথমে এ গান গাইয়েছিলেন সাবিনা ইয়াসমিনকে দিয়ে। সাবিনার পরে গেয়েছিলেন রুনা। ঢাকায় ফোনে ধরেছিলাম সে গানের গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ারকে। তিনি যা বললেন, তাতে আলাউদ্দিন আলি রুনাকে দিয়ে এ গান করেন কলকাতায়। পুরোনো কনকর্ড রেকর্ডের মালিক বিশ্বনাথ চট্টোপাধ্যায়ের উদ্যোগে। ‘ওদের স্টুডিয়ো উদ্বোধন উপলক্ষ্যে ওই গানটি গাওয়ানো হয়। রুনা সবে পাকিস্তান থেকে এসেছে। পরে এ গান আলাউদ্দিন ভাই ‘কসাই’ ছবিতে রুনাকে দিয়ে গাওয়ান। সাবিনার এ গান গাওয়ার কথা শুনিনি।’, বললেন মাজহারুল। সালের হিসেব তাঁর নেই। ঢাকার বিখ্যাত চ্যানেল আই টিভিতে দু’বছর আগে কিন্তু আলাউদ্দিন নিজে বলেছিলেন, ‘সে সময় আমরা প্রতিদিন গাজী মাজহারের বাড়িতে বসতাম। এমনই একদিন ‘বন্ধু তিন দিন’ গানটা বেরিয়ে আসে গাজী মাজহারের লেখনীতে। আর আমিও হারমোনিয়াম বাজিয়ে সুরটা তুলে ফেলি। প্রথমে সাবিনা ইয়াসমিনের কণ্ঠে গানটি রেকর্ড করা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে ‘কসাই’ ছবিতে গানটি গেয়েছিলেন রুনা লায়লা।’

another alauddin

মীরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানের যেখানে সমাহিত হলেন আলাউদ্দিন, পাশেই চিরনিদ্রায় বাংলাদেশের গানের তিন অতি পরিচিত নাম আজম খান, লাকী আখান্দ্ও আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। মৃত্যুর পরও যেন তাঁরা একে অপরের প্রতিবেশী। কিন্তু আলাউদ্দিন অনেক বেশি আন্তর্জাতিক। কলকাতায় গৌতম ঘোষের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ থেকে স্বপন সাহার ‘বাবা কেন চাকর’—অজস্র সিনেমায় সুর দিয়েছেন। এত ব্যস্ত সুরকার ছিলেন, একটা সময় নিজে হয়তো মুম্বইতে সুর করছেন, এক সহকারী গান তোলাচ্ছেন কলকাতায়, অন্য সহকারী ঢাকায়। আলাউদ্দিন গানও লিখতেন।

কলকাতায় তাঁর সহকারী ছিলেন শহরের অতিপরিচিত গিটারিস্ট স্বপন সেন। যিনি মান্না-হেমন্ত-সন্ধ্যা-মানবেন্দ্রর সঙ্গে নিয়মিত অনুষ্ঠান করতেন। সত্যজিৎ রায়ের একাধিক সিনেমায় ছিলেন মিউজিক অ্যারেঞ্জমেন্টে। স্বপন বলছিলেন, ‘ওঁর সঙ্গে অনেক কাজ করেছি। নিজে পিয়ানো ভালো বাজাতেন। বেহালাও। ফলে গানের মধ্যে পশ্চিমী স্টাইলের পাশাপাশি গ্রাম ভাবনার সুরের ছাপ থাকত। দুটো মেশাতে পারতেন ভালো।’ আলাউদ্দিনের অজস্র গানের গীতিকার মাজহারুল আনোয়ার আবার ঢাকা থেকে বললেন, ‘ওঁর সুরের বেসটা দারুণ ছিল। আনোয়ার পরভেজের সহকারী হিসেবে কাজ করায় ভিত পোক্ত হয়ে যায়।’

আলাউদ্দিনের সুরের দক্ষতা এতটা পরিচিত ছিল বাংলাদেশে, তাঁর জন্য একবার স্বাধীনতা দিবসে দশটা গান লিখে দিয়েছিলেন বাংলাদেশের কিংবদন্তি কবি সামশুর রহমান। সাবিনা ইয়াসমিন গেয়েছিলেন, ‘এই যে আমার খুকির ঠোঁটে ফুটছে হাসি’, ‘স্বজন হারানোর বিয়োগ ব্যথায় আর কতকাল তুমি করবে শোক’, ‘স্বপ্নে আমার যে দেশ ওঠে জেগে’-র মতো গান। এন্ড্রু কিশোর গেয়েছিলেন ‘নয় কোটি জনতা জাগ্রত আজ’। গোটা দেশ ভেসে গিয়েছিল মুগ্ধতায়। এত জনপ্রিয় গান তাঁর, তালিকা করতে যাওয়াটা বোকামি। সেরা কুড়ি বানাতে গেলেও তাচ্ছিল্য শুনতে হবে, ‘আরে, ওই গানটাই লেখেননি?’

কোনও গানে রুনা, কোনওটায় সাবিনা, কোনও গানে মিতালি, কোনওটায় এন্ড্রু জেগে থাকেন আলাউদ্দিনের সুরে। কোনওটায় প্রেম, কোনওটায় দেশপ্রেম। কিছু গান মনে করায় পল্লীগীতি, কিছু গান পশ্চিমী স্টাইল। অত্যাশ্চর্য বৈচিত্র্য মুন্সিগঞ্জের বাঁশবাড়ির ছেলের সুরে।

এ ভাবে চরম বিস্ময় নিয়ে শুনে যেতে হয় আলাউদ্দিনের সুরে বৈচিত্র্যের জয়গান। ‘প্রথম বাংলাদেশ, আমার শেষ বাংলাদেশ’, ‘সূর্যোদয়ে তুমি, সূর্যাস্তেও তুমি ও আমার বাংলাদেশ’, ‘জন্ম থেকে জ্বলছি মাগো, ‘হয় যদি বদনাম হোক আরও’, ‘হায় রে কপাল মন্দ চোখ থাকিতে অন্ধ’, ‘এমনও তো প্রেম হয়, চোখের জলে কথা কয়’, ‘সবাই বলে বয়স বাড়ে, আমি বলি কমেরে’, ‘আমায় গেঁথে দাওনা মা গো, একটা পলাশ ফুলের মালা’, ‘শত জনমের স্বপ্ন তুমি আমার জীবনে এলে’।

এক একটা গান মনের একটা করে জানলা খুলে দিয়ে যায় নিঃশব্দে। ঠিকই বলেছিলেন ভূপিন্দর। ঠিক যেন আমাদের রাহুলদেব। সূর্যোদয়ে তুমি, সূর্যাস্তেও তুমি ও আমার আলাউদ্দিন।

গল্প রেট করুন