মীরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানের যেখানে সমাহিত হলেন আলাউদ্দিন, পাশেই চিরনিদ্রায় বাংলাদেশের গানের তিন অতি পরিচিত নাম আজম খান, লাকী আখান্দ্ও আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। মৃত্যুর পরও যেন তাঁরা একে অপরের প্রতিবেশী। কিন্তু আলাউদ্দিন অনেক বেশি আন্তর্জাতিক। কলকাতায় গৌতম ঘোষের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ থেকে স্বপন সাহার ‘বাবা কেন চাকর’—অজস্র সিনেমায় সুর দিয়েছেন। এত ব্যস্ত সুরকার ছিলেন, একটা সময় নিজে হয়তো মুম্বইতে সুর করছেন, এক সহকারী গান তোলাচ্ছেন কলকাতায়, অন্য সহকারী ঢাকায়। আলাউদ্দিন গানও লিখতেন।
কলকাতায় তাঁর সহকারী ছিলেন শহরের অতিপরিচিত গিটারিস্ট স্বপন সেন। যিনি মান্না-হেমন্ত-সন্ধ্যা-মানবেন্দ্রর সঙ্গে নিয়মিত অনুষ্ঠান করতেন। সত্যজিৎ রায়ের একাধিক সিনেমায় ছিলেন মিউজিক অ্যারেঞ্জমেন্টে। স্বপন বলছিলেন, ‘ওঁর সঙ্গে অনেক কাজ করেছি। নিজে পিয়ানো ভালো বাজাতেন। বেহালাও। ফলে গানের মধ্যে পশ্চিমী স্টাইলের পাশাপাশি গ্রাম ভাবনার সুরের ছাপ থাকত। দুটো মেশাতে পারতেন ভালো।’ আলাউদ্দিনের অজস্র গানের গীতিকার মাজহারুল আনোয়ার আবার ঢাকা থেকে বললেন, ‘ওঁর সুরের বেসটা দারুণ ছিল। আনোয়ার পরভেজের সহকারী হিসেবে কাজ করায় ভিত পোক্ত হয়ে যায়।’
আলাউদ্দিনের সুরের দক্ষতা এতটা পরিচিত ছিল বাংলাদেশে, তাঁর জন্য একবার স্বাধীনতা দিবসে দশটা গান লিখে দিয়েছিলেন বাংলাদেশের কিংবদন্তি কবি সামশুর রহমান। সাবিনা ইয়াসমিন গেয়েছিলেন, ‘এই যে আমার খুকির ঠোঁটে ফুটছে হাসি’, ‘স্বজন হারানোর বিয়োগ ব্যথায় আর কতকাল তুমি করবে শোক’, ‘স্বপ্নে আমার যে দেশ ওঠে জেগে’-র মতো গান। এন্ড্রু কিশোর গেয়েছিলেন ‘নয় কোটি জনতা জাগ্রত আজ’। গোটা দেশ ভেসে গিয়েছিল মুগ্ধতায়। এত জনপ্রিয় গান তাঁর, তালিকা করতে যাওয়াটা বোকামি। সেরা কুড়ি বানাতে গেলেও তাচ্ছিল্য শুনতে হবে, ‘আরে, ওই গানটাই লেখেননি?’
কোনও গানে রুনা, কোনওটায় সাবিনা, কোনও গানে মিতালি, কোনওটায় এন্ড্রু জেগে থাকেন আলাউদ্দিনের সুরে। কোনওটায় প্রেম, কোনওটায় দেশপ্রেম। কিছু গান মনে করায় পল্লীগীতি, কিছু গান পশ্চিমী স্টাইল। অত্যাশ্চর্য বৈচিত্র্য মুন্সিগঞ্জের বাঁশবাড়ির ছেলের সুরে।
এ ভাবে চরম বিস্ময় নিয়ে শুনে যেতে হয় আলাউদ্দিনের সুরে বৈচিত্র্যের জয়গান। ‘প্রথম বাংলাদেশ, আমার শেষ বাংলাদেশ’, ‘সূর্যোদয়ে তুমি, সূর্যাস্তেও তুমি ও আমার বাংলাদেশ’, ‘জন্ম থেকে জ্বলছি মাগো, ‘হয় যদি বদনাম হোক আরও’, ‘হায় রে কপাল মন্দ চোখ থাকিতে অন্ধ’, ‘এমনও তো প্রেম হয়, চোখের জলে কথা কয়’, ‘সবাই বলে বয়স বাড়ে, আমি বলি কমেরে’, ‘আমায় গেঁথে দাওনা মা গো, একটা পলাশ ফুলের মালা’, ‘শত জনমের স্বপ্ন তুমি আমার জীবনে এলে’।
এক একটা গান মনের একটা করে জানলা খুলে দিয়ে যায় নিঃশব্দে। ঠিকই বলেছিলেন ভূপিন্দর। ঠিক যেন আমাদের রাহুলদেব। সূর্যোদয়ে তুমি, সূর্যাস্তেও তুমি ও আমার আলাউদ্দিন।